শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ আদালতে বিচারপ্রার্থী চল্লিশোর্ধ রানু কবীর। সঙ্গে তাঁর ষোড়শী মেয়ে হ্যাপী। আসামীদ্বয় লিয়াকত ও মান্নান কম্পমান অবস্থায় দুই হাত জোড়া করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। কাহিনীটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩) এর ৯ (১) ধারায় করা একটি মামলার আরজি এবং অন্যান্য দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এই ধারায় উল্লেখ আছে, মামলা প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদ্বয়ের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ধারার আইনগত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সন্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শণ বা প্রতারণামূলকভাবে তার সন্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সন্মতিসহ বা সন্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।
আরজির বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ এরকম যে, রানু কবির তাঁর মেয়ে হ্যাপীকে নিয়ে বসবাস করেন শ্বশুরের ভিটায়। স্বামী একজন প্রবাসী। বছরে একবার বাড়ি এসে পরিবার-পরিজনদের দেখে যান। রানু কবিরের অভিযোগের বর্ণনায় বলা হয়েছে তিনি ও তাঁর মেয়ে ঘটনার দিন নিজ বসতঘরে অবস্থান করছিলেন। তখন বিকেল প্রায় তিনটা। আকস্মিকভাবেই তাঁর ঘরে আগমন করল আসামিরা। কিছু বোঝার আগেই রানু কবীরকে আসামী লিয়াকত ধর্ষণ করতে শুরু করল। একইভাবে মেয়ে হ্যাপীকে পাশের ঘরে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে মান্নান। ধর্ষণ শেষে আসামিরা বীরদর্পে বেরিয়ে যায়। চিৎকার দিয়ে ডাকাডাকি করলেও পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। কারণ আসামিরা অত্যন্ত দাঙ্গাবাজ লোক।
অভিযোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে রানু কবীর তাঁর আঁচল দিয়ে ও মেয়ে হ্যাপী তাঁর ওড়নায় মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেললেন। এজলাস কক্ষে এক অভাবনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। উপস্থিত জনগণ পারলে আসামিদের পিটুনি শুরু করে দেয়। কিন্তু মাননীয় বিচারক মহোদয়ের এজলাস কক্ষে এরূপ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার সুযোগ কারও নেই। তাই রক্ষে। আসামিরা করজোরে বিচারকের কাছে নিবেদন করল তারা দুই ভাই নির্দোষ, তারা বিচারপ্রার্থী। অবশ্য সাজা এড়াতে অপরাধীরা এরূপ বেশভুষায় সজ্জিত হয়ে থাকে। তাই আসামিদের কথার সত্যতা বিচারের আগেই এরূপ পরিবেশে নির্ণয় করার সুযোগ খুবই কম। বিজ্ঞ বিচারক বিচারের দিন ধার্য করলেন। নির্ধারিত দিনে বিচারকাজ শুরু হলো। পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোকদ্দমা বিচারের জন্য উপস্থাপন করলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে ডাক পড়ল ফরিয়াদী (বাদী) রানু কবীরের। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রানু কবীর হলফ পড়লেন ‘আমি প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি যে, এই মোকদ্দমায় আমি যে সাক্ষ্য দিব তা সত্য হইবে, ইহার কোনো অংশ মিথ্যা হইবে না এবং আমি কোনো কিছু গোপন করিব না।’ বিচারক লক্ষ করলেন রানু কবীর হলফ পড়তে গিয়ে ইতস্তত বোধ করছিলেন এবং তাঁর গলা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছিল। সবাই উদগ্রীব নির্যাতিতা রানু কবীরের ফরিয়াদ শোনার জন্য। কিন্তু রানু কবীরের মুখে কোনো কথা নেই। প্রশ্ন জাগে, কেন এই নীরবতা। বিচারক অত্যন্ত সহানুভূতিমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন রানু কবীরকে, তাঁকে কেউ ভয় দেখিয়েছে কি না। তারপরও রানু কবীর নীরব। বিচারকের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, বার বার তিনি রানু কবীরকে অভয় দিতে থাকেন, আশ্বাস দিতে থাকেন তাঁর সর্বাঙ্গীন নিরাপত্তা বিধানের। সব শেষে রানু কবীর অস্ফুট কণ্ঠে বলেন, ‘সব দিয়ে দিয়েছে’। বিস্মিত বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, কী দিয়ে দিয়েছে? এ সময় এগিয়ে আসেন আইনজীবী, তিনি জানান যে পৈত্রিক সম্পত্তিতে ফরিয়াদির স্বামীর প্রাপ্য অংশ দিয়ে দিয়েছে আসামিদ্বয়। এবার বিচারের কাঠগড়ায় দ-ায়মান ফরিয়াদি রানু কবীরকে জিজ্ঞেস করেন আসামি তাঁকে ধর্ষণ করেছে কি না। প্রশ্ন শুনে লজ্জাবনত হয়ে পড়েন রানু কবীর, তিনি জবাব দেন ‘না, আমার ভাসুর লিয়াকত সজ্জন ব্যক্তি। তিনি আমার সঙ্গে কখনোই কোনো খারাপ বা অশালীন আচরণ করেননি। সম্পত্তির ভাগাভাগি ত্বরান্বিত করার জন্যই মামলা করেছিলাম। নালিশ দরখাস্তের বক্তব্য আমার নয়, ভাশুরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে নালিশ দায়ের করতে আমি কাউকে কোনো নির্দেশনা দিইনি।’
এরপর ডাক পড়ে সাক্ষী হ্যাপীর। যথারীতি হলফ পড়ানোর পর তাঁকেও বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, আসামি মান্নান-আলম তাঁকে ধর্ষণ করেছে কি না। তিনিও তাঁর মায়ের মতোই জবাব দেন। তাঁর সঙ্গে শ্রদ্ধেয় চাচাকে জড়িয়ে ধর্ষণের যে কথা বলা হয়েছে তা জেনে তিনি যারপরনাই লজ্জিত হন। ঘটনা এরপর পরিষ্কার হয়ে যায় বিচারকের সামনে। লিয়াকত, মান্নান ও রহিম এঁরা তিন ভাই। তাঁদের এজমালি সম্পত্তিতে রয়েছে একটি বিশাল আমগাছ। ওই গাছের আম পাড়তে গিয়েছিলেন হ্যাপী। আমগাছের ডাল ভেঙে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁকে ওই সময় আম পাড়তে নিষেধ করেন তাঁর চাচা। এই নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত। তখন রানু কবীর সিদ্ধান্ত নেন তাঁর স্বামীর পৈর্তৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেবে। তাঁর স্বামী এতে রাজি হননি। তখন রানু কবীর তাঁর স্বামীকে না জানিয়ে শরণাপন্ন হন পরিচিত এক ব্যক্তির। তার পরই মামলার সূত্রপাত।
মানুষের ‘মৃত্যু’ কথাটি সত্য কিন্তু বেঁচে থাকা কথাটি মিথ্যা। মৃতের লাশের সাথে কিছুই যাবে না-এটিও সত্য। তাই যদি হয়, তাহলে সত্য পথে জীবনধারণ করা উত্তম। অথচ এ চরম সত্যটি জানা সত্ত্বেও মানুষ কত ধরণের মিথ্যাচার করছে, অপরাধ করছে। সেসব প্রতিরোধের জন্য প্রণীত হয়েছে আইন, আছে সাজার ব্যবস্থা। তারপরও মিথ্যাচার, ভন্ডামী মুক্ত সমাজ উপহার পাচ্ছে না জাতি। প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের মামলাকে মিথ্যা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্রমূলক জড়ানো হচ্ছে। ফলে আসল নির্যাতনের ঘটনা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে এবং প্রকৃত অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলায় কঠিন শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান তাহা হইলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করাইয়াছেন উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-নীয় হইবেন।’ এই রক্ষাকবচ সত্ত্বেও ওইসব অন্যায্য মামলা দায়ের করা বন্ধ হয়নি। এসব অন্যায্য মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেওয়া এবং দরখাস্ত মুসাবিদা করে দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। অনেক ক্ষেত্রেও এইসব দরখাস্তগুলো অশালীন ভাষায় লেখা হয়। এই আইনের অধীনে মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সাজা হচ্ছে খুব কম। কম সাজা হওয়ার কারণগুলো উপরের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়।
এছাড়া দন্ডবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান প্রভৃতি সম্পর্কে বিধান বর্ণিত হয়েছে। দন্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দান সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সত্য কথনের জন্য হলফ বা আইনের প্রকাশ্য বিধান অনুসারে আইনত বাধ্য হয়ে বা কোনো বিষয়ে কোনো ঘোষণা করার জন্য আইন অনুসারে বাধ্য হয়ে এমন কোনো বিবৃতি দান করে, যা মিথ্যা এবং যা সে মিথ্যা বলে জানে বা বিশ্বাস করে বা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, সেই ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বলে গণ্য হবে।
কোনো বিবৃতি মৌখিকভাবে বা পক্ষান্তরে যেভাবেই দেয়া হোক তা এ ধারার অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রত্যয়নকারী ব্যক্তির বিশ্বাসসংক্রান্ত মিথ্যা বিবৃতি এ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য হবে। এছাড়া যে ব্যক্তি বলে যে, সে এমন কোনো বস্তুতে বিশ্বাস করে, যা সে প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করে না এবং যে ব্যক্তি বিবৃতি দিয়ে বলে যে, সে এমন কোনো বিষয় জানে, যা সে প্রকৃতপক্ষে জানে না, তারাও মিথ্যা সাক্ষ্য দানের জন্য দোষী সাব্যস্ত হতে পারে।
দন্ডবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি বিচারবিভাগীয় কোনো মামলার পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা মিথ্যা সাক্ষ্য উদ্ভাবন করলে সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার জন্য কারাদন্ড পেতে পারে, যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং একই সঙ্গে তাকে অর্থদন্ডে দন্ডিতও করা যেতে পারে।
অন্য কোনো মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮